নিয়াজ শেখ | বরিশাল | ০৪ নভেম্বর ২০২৫
কেউ কেউ কলমে গল্প লেখেন, কেউবা গানে। কিন্তু অর্নব দত্ত গল্প বলেন তার ক্যামেরার লেন্স দিয়ে। আলো, ছায়া আর ফ্রেমের নিখুঁত মিশ্রণে তিনি বলেন জীবনের কথা—ভালোবাসা, সংগ্রাম আর সাফল্যের গল্প। বরিশালের এই তরুণ ফটোগ্রাফার আজ দেশের ফটোগ্রাফি দুনিয়ায় এক উদীয়মান নাম।
ছোটবেলা থেকেই ছবি তোলার নেশা ছিল অর্নবের। তবে জীবনের বাস্তবতা তাকে থামিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ বাবার মৃত্যু আর পারিবারিক আর্থিক সংকটে ভেঙে পড়েছিল স্বপ্ন। পরিবারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তার জীবন মোড় নেয় অন্য পথে।
২০১৬ সালে বরিশালের স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনের চাকরি নিয়ে শুরু হয় তার সংগ্রামের অধ্যায়। কিন্তু সেই কঠিন সময়ও তার ফটোগ্রাফির প্রতি টান মুছে দিতে পারেনি। সময় পেলেই হাতে তুলে নিতেন ক্যামেরা—কখনও ধার করা, কখনও পুরনো কোনো মডেল।
অর্নব বলেন, “প্রথম দিকে কেউ আমাকে ক্যামেরা পর্যন্ত দিতে চাইতো না। আমি তখন বুঝেছি, সুযোগ নিজেই তৈরি করতে হয়। তাই ইউটিউব দেখে, রাত জেগে প্র্যাকটিস করে নিজের স্কিল তৈরি করেছি, শিখেছি এডিটিং এর কাজ।
২০২০ সালে, মহামারির সময় যখন পৃথিবী থমকে গিয়েছিল, তখন অর্নব নিজের জীবনের নতুন সূচনা করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘এডি ফটোগ্রাফি অ্যান্ড ফ্রেম’, নিজ মালিকানাধীন ফটোগ্রাফি ও সিনেমাটোগ্রাফি ফার্ম। এখান থেকেই শুরু হয় তার প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা।
শুরুটা ছিল ছোট পরিসরে—কখনও বিয়ের ছবি, কখনও বন্ধুদের অনুষ্ঠান। কিন্তু ধীরে ধীরে তার কাজের মান ও দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের নজরে আসে। তিনি বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট না থাকলেও আমি বিশ্বাস করতাম, কাজই আমার ডিগ্রি। আর সেই কাজের মানই আমার পরিচয়। অর্নবের এই দীর্ঘ পথচলার অনপ্রেরনা হয়ে সবসময় পাশে ছিলেন তার মমতাময়ী মা এবং মাসী।
বর্তমানে অর্নব কাজ করছেন উইডিং ফটোগ্রাফি, প্রোডাক্ট ও মডেল ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি, মিউজিক ভিডিও, ফিল্ম মেকিং, আউটডোর রিলস শুট ও সরকারি প্রজেক্ট ডকুমেন্টারি তৈরিতে।
তার ফটোগ্রাফি ফার্ম ইতোমধ্যে কাজ করেছে একাধিক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইনকাম ট্যাক্স, সাউথ অ্যাপোলো মেডিকেল কলেজ, বিআরটিএ, মমতা কমপ্লেক্স হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। তাদের কর্পোরেট প্রোফাইল, প্রমোশনাল ভিডিও ও ডকুমেন্টারি নির্মাণের কাজ অর্নব ও তার টিম সম্পন্ন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
এছাড়া ঈদ, কুরবানী, দুর্গাপূজা, রথযাত্রা, হোলি, এমনকি স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও তার লেন্স ধারণ করেছে সামাজিক ও ধর্মীয় আবেগের অসংখ্য অনন্য মুহূর্ত।
তার কাজ সীমাবদ্ধ নয় শুধু সাধারণ প্রজেক্টেই। বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গনের তরুণ তারকাদের সঙ্গেও তিনি কাজ করেছেন। এর মধ্যে আছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মান ও অভিনেতা ইয়াশ রোহান। অর্নব জানান, “তারকাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে আরও পেশাদার ও দায়িত্বশীল হতে শিখিয়েছে। প্রতিটি প্রজেক্টে আমি গল্প বলতে চাই—ফ্রেমে যেন অনুভূতি থাকে।”
তার এই ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে এখন দেশের বাইরে থেকেও কাজের প্রস্তাব পাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি তিনি কলকাতায় একটি আন্তর্জাতিক উইডিং ফটোগ্রাফি প্রজেক্টে কনট্রাক্ট সই করেছেন। এছাড়া আগামী বছরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সিনেমাটোগ্রাফি ও ব্র্যান্ড ডকুমেন্টারি কাজ হাতে রয়েছে।
অর্নবের মতে, ফটোগ্রাফি শুধু পেশা নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি—জীবনকে দেখার আরেকটি উপায়। “আমি চাই, আমার ছবিতে মানুষ নিজের গল্প খুঁজে পাক। আলো, ছায়া আর সময়ের মিশ্রণে আমি শুধু ছবি নয়, অনুভূতি ধারণ করতে চাই,” বলেন তিনি।
অর্নব বিশ্বাস করেন, সাফল্যের মূল রহস্য অধ্যবসায় ও শেখার আগ্রহ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও প্রতিটি অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কিছু না কিছু শিখেছেন। এখন তার লক্ষ্য—এই অভিজ্ঞতা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।
“আজকের তরুণরা অনেক প্রতিভাবান। আমি চাই তারা যেন হাল না ছাড়ে। ক্যামেরার পেছনে শুধু প্রযুক্তি নয়, প্রয়োজন ধৈর্য, কল্পনা আর ভালোবাসা,” বলেন অর্নব দত্ত।
তার ক্যামেরার প্রতিটি ক্লিক যেন এক একটি গল্প—যেখানে জীবনের রং, সময়ের স্পর্শ আর এক তরুণের অদম্য সংগ্রাম ধরা পড়ে। বরিশালের এই তরুণ প্রমাণ করেছেন—যখন ভালোবাসা আর পরিশ্রম এক হয়, তখন ক্যামেরার লেন্সই হয়ে ওঠে জীবনের ভাষা।
https://slotbet.online/