নিয়াজ শেখ :
“আগুন না থাকলে ধোঁয়া ওঠে না”—এই প্রবাদটি যেন হুবহু খাটে জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা শুভ্র প্রকাশ দে এবং তার স্ত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ঈষিতা দে-এর ক্ষেত্রে। বরিশালে এই দম্পতির বিরুদ্ধে উঠেছে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও পারিবারিক নির্যাতনের একের পর এক অভিযোগ। স্থানীয়দের ভাষায়—তারা এমন এক প্রভাবশালী দম্পতি, যাদের ছায়া থেকে কেউ সহজে রেহাই পায় না।
চাকরির ছত্রছায়ায় উভয়ই রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলো বেশ আগ থেকেই। ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারি বিধি ভেঙে ঈষিতা দে সরাসরি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ও নির্বাচন আচরণবিধি অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু ঈষিতা দে কেবল অংশই নেননি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিও প্রকাশ করেন।
একইভাবে, তার স্বামী শুভ্র প্রকাশ দে—জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা হয়েও—বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচনী মিছিলে অংশগ্রহণ করেন এবং মেয়রের সঙ্গে তোলা ছবিও প্রকাশ করেন। এই বিধিভঙ্গের পরও তাদের কোনো জবাবদিহি হয়নি। ৫ আগষ্ট পরবর্তী সময়েও তারা কোন ক্ষমতার বলে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে সাধারন নাগরীক সমাজ এনিয়ে প্রশ্ন তুলছে, স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নীরবতাও প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশাসনের ভূমিকা যেন “মুখে হাসি, মনে বাঁশি”—বাইরে নীরব, ভেতরে গোপন সমঝোতা। দম্পতির বিরূদ্ধে রয়েছে নিজ বাবা- মা কে নির্যাতন এবং তাদের সাথে প্রতারনার অভিযোগ। শুভ্রর পিতা বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের দপ্তরে অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানা যায় কর্তৃপক্ষ। সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগটি হলো বরিশালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাশিপুর তেতুলতলা এলাকার প্রায় এক একর জমি কেনাবেচা নিয়ে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই জমির মালিক হয়েছেন সরকারি ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের স্ত্রীগণ। এই জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। অথচ জমি ক্রেতাদের অধিকাংশের বৈধ আয়ের উৎস নেই। অভিযোগ রয়েছে, ওই সম্পত্তি কেনা হয়েছে কালো টাকা সাদা করার জন্য যার নেতৃত্বে ছিলো এই দম্পতি। আওয়ামী সরকার পতনের পর গ্রীন সিটি ডেভেলপার্স নামে প্রতিষ্ঠানটির সাইনবোর্ড অপসারন করলেও তাদের কার্যক্রম চলমান এখনও। গোপনে চলছে জমি বিক্রির প্রক্রিয়া। শুভ্র প্রকাশ দে নিজেও ওই জমির ১২ শতাংশ মালিক হয়েছেন। জানা যায় নিজের পিতার সঙ্গে প্রতারণা করে এই মালিকানা অর্জন করেন। শুভ্রর অংশের জমি বিক্রি করতে গেলে পিতার সাথে প্রতারনার বিষয়টি জনসম্মুখে আসে। এনিয়ে পিতা পুত্রের বিরোধ এখন টক অফ দা টাউন। অপরদিকে কাগজকলমে পুরো জমির মালিকদের মধ্যে আছেন জনতা ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের স্ত্রীরা। কিন্তু বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ করছেন শুভ্র-ঈষিতা দম্পতি এবং মিজানুর রহমান। বরিশাল গ্রীন সিটি ডেভেলপার্স” নামের প্রতিষ্ঠানটি বাইরে থেকে জমি উন্নয়ন প্রকল্পের মতো দেখালেও, ভেতরে চলছে অবৈধ অর্থ সাদা করার প্রক্রিয়া। স্থানীয়দের মতে, “নদীতে ভাসে কাঠ, পচে ভিতরে”—দেখতে উন্নয়ন, আসলে দুর্নীতির জাল। স্থানীয়রা জানায়, বরিশাল সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের মাধ্যমে জমি বিক্রির সময় প্রকৃত মূল্য গোপন করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়। জমির দাম বাজারমূল্যের অর্ধেক দেখিয়ে বিক্রির বায়না রেজিস্ট্রি করা হয়, এতে সরকারের কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়। এই কর্মকর্তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করছেন, অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাচার করছেন এবং পরে রেমিট্যান্স আকারে দেশে ফিরিয়ে আনছেন। এছাড়া, কাশিপুর এলাকায় তাদের নামে একাধিক প্লট, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ মেলেছে। অবৈধ উপায় ছাড়া রাতারাতি কোটিপতি হওয়া যায় না—তবে এই দম্পতির কাছে যেন সবই সম্ভব। শুভ্র প্রকাশ দে’র অবৈধ সম্পদ, কর্মকাণ্ড ও শৃঙ্খলাভঙ্গ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রধান কার্যালয়ের ঊদ্ধর্তন কর্মকর্তাকে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তারা জানায় এই ধরনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে খুব শীঘ্রই তাকে চাকুরী থেকে অপসারনসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্য একটি সুত্র বলছে এই দম্পতি নতুন করে রাজনৈতিক শক্তির উৎসকে অপকর্মের হাতিয়ার করার উদ্দেশ্যে এখন বিএনপির এক নেতার শরণাপন্ন হয়েছেন। দল বদলালেও প্রভাবের কাঠামো অটুট—যা প্রমাণ করে, তাদের মূল শক্তি প্রশাসনিক ও আর্থিক নেটওয়ার্কে। সরকারি আচরণবিধি ভঙ্গ, পারিবারিক নির্যাতন, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং, রাজস্ব ফাঁকি, ক্ষমতার অপব্যবহার সবকিছু মিলে এটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং প্রশাসনিক ও নৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। “ঢাকঢোল পিটিয়ে সত্য লুকানো যায় না”—এই বাস্তবতাই এখন বরিশালের মানুষের মুখে মুখে। এ বিষয়ে শুভ্র প্রকাশ দে’র বক্তব্য জানতে একাধিকবার তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে তিনি কল রিসিভ করেননি। দায়মুক্তির চাদরে ঢাকা এই প্রভাবশালীদের বিচার কবে হবে? এমন আশংকার কথাই জানায় সচেতন নাগরীক সমাজ।
https://slotbet.online/